মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস ও শান্তির নীতি মেনে বিশ্বমঞ্চে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তার আহ্বানে ভারতবর্ষের লাখো কোটি মানুষ জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ন্যায়ভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বিশেষত ১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন বা ‘সত্যাগ্রহ‘ আন্দোলন ছিল একটি বৈশ্বিক উদাহরণ, যা শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বজুড়ে সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মানবাধিকার আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল।
১৯১৫ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর শুরু করেন তার অহিংস আন্দোলন, যা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের ভিত রচনা করে। তবে সহিংসতা কিংবা হিংসাত্মক আচরণ কখনই তাদের আদর্শ ছিল না।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি আজও বিশ্বের বহু মানুষের কাছে শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমানে ভারতের রাজনীতি, বিশেষত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং এর সহযোগী সংগঠন গেরুয়া শিবিরের সহিংস কর্মকাণ্ডে গান্ধীর অহিংস নীতি থেকে সরে আসার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসলে দেখা যায়, এক সময় ভারতের যেসব নেতারা ধর্মের নামে সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলতেন, শক্ত অবস্থান নিতেন, তারাই এখন রাজনৈতিক এবং দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিচ্ছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারে বিজেপির অনেক নেতা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও হিংসাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজ ও জাতিতে অশান্তি ও অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় বিজেপির উগ্র সমর্থকদের সহিংসতা চরম মাত্রায় চলে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ এবং শান্তিবাদী মানুষের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব তোয়াক্কা না করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির আঞ্চলিক নেতার মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে বেশ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করছেন, যা দেশের সামাজিক শান্তি ও সুরক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশেষত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের উসকানিমূলক বক্তব্য গোটা ভারতের সমাজভিত্তিক ঐক্যকে দৃঢ় করার বদলে দুর্বল করে দিচ্ছে
মহাত্মা গান্ধীর শান্তি ও সহিষ্ণুতার নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্যে নয় দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্যও বিপজ্জনক। সেই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের অধিপত্যবাদ হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশে উত্তাল গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাসহ ছাত্র নেতারা ভারতের কর্তৃত্ববাদীতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি হিন্দুত্ববাদী বিতর্কিত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণদাসের গ্রেফতার এবং তার পরোক্ষ ইন্ধনে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে চরম অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে সোমবার (২ ডিসেম্বর) বিজেপির উগ্র সমর্থক এবং নেতাকর্মীরা ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন। এই ঘটনায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ন্যক্কারজনক এই হামলার পরপরই নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারও হামলার ঘটনায় গভীর দুঃখপ্রকাশ করেছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে।
এদিকে, ভারতের চলমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যেভাবে তীব্রমাত্রায় সহিংসতা এবং ধর্মভিত্তিক বিভাজন-সংঘাত বাড়ছে, তাতে মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্নের অহিংস ভারত থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন গেরুয়ারা। গান্ধীর অহিংস নীতি যা অবিভক্ত ভারতের ঐক্য এবং সমাজে শান্তি বজায় রাখতে কার্যকর ছিল, তা বর্তমানে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে চরম হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং তার উগ্রবাদী বেশি কিছু সমর্থক এবং নেতারা যেভাবে সহিংসতা এবং ধর্মীয় উসকানির মাধ্যমে রাজনীতি করছেন, তা ফের প্রশ্নবিদ্ধ করছে ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্যবাহী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহিষ্ণু মানসিকতাকে। মহাত্মা গান্ধীর উদাত্ত আহ্বান থেকে কতটা দূরে সরে গিয়ে দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অশান্তি এবং অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা বুঝতে পারা এখন কারও জন্য আর কঠিন কিছু নয়।
Leave a Reply